আমার ব্লগের একটা নাম দেবো। কবিতা না। কোন রঙচঙা বইয়ের নামকরণও না। একটা নাম ঠিক করতে হবে এই মুহূর্তে। আমার প্রতিচ্ছবির ভাব মূর্তির জন্য। ছোট-খাটো কোন পুরুষ বৃক্ষ বা কোন নারী লতা’র কাছেই এমন জিজ্ঞাসা থাকবে। কি নাম রাখবো আমার পুকুরের। যে পুকুরে শ্যাওলা জুড়ে ছায়ার তলে বাস করে এক মৎস্য-কুমারী। সারাবেলা বসে থাকি তাকে দেখবো বলে। এমনকি জন্ম থেকে আজও অপেক্ষারত দুটি শাপলা কুমারী এখনও সঙ্গী হয় আমার। দিন যতো কাটে ততোই প্রেম গাঢ় হবে বলে ধারণা পা তোলা ডাহুকের আর পাখা ঝাপটানো বক পাখীর। সেও আসে মাঝ রাতে বা আঁধার পথে। কখনো কখনো সাঁঝের আঁধারে সংগীতে উন্মাদনা জোগান দেয় রাতের পোকামাকড়ের দল।
এক, দুই বা তিন বলেই যদি চোখ খুলে দেখি তাকে! কি আশ্চর্য এমন যদি হতো। এক পূর্ণিমা রাতে সেই শাপলা খোঁপায় এঁটে মৎস্য-কুমারী হাত ধরে যদি বলে, ‘চলো যাবে দূরের দেশে, জলে ভেসে। সাঁতরে নেবো মানবহীন শূন্য কোলাহলে, এক ঝাঁক রঙিন সুস্থ প্রজাপতী আর জল-ডাঙার পৃথিবীতে।’ আজও বসে অপেক্ষার পালা সেই পূর্ণিমার চলে যাবার প্রাক্কালে। কই এলো না-তো আমার প্রিয় পথ-ভোলা স্বপ্ন কুমারী। ভাগ্য প্রতিমা যখন সহায় হনই না বা মুখ ফিরিয়ে নেন অযথাই; বসে অপেক্ষা ছাড়া কি-ই বা করতে পারি আমি।
আরে ঐ তো মৎস্য-কুমারী। জলের ধারে, আধো উন্মুক্ত বুকে আঁচল সরিয়ে দুলে দুলে হাসছে আর আসছে আমার দিকে। কোন যুবকের প্রতি এমন আসক্তি তার? আমি তো? নাহ্। আমি না নিশ্চয়ই। হবে কোন ভাগ্যবান পাখীর মালিক। বউ কথা কও, ফিঙ্গে বা মাছরাঙা শিকারী’র। তারই কাছে ফিরছে হয়তো মৎস্য-কুমারী। আমার চেয়ে দেখা খসে পড়া দু’টি তারা যেন দূরে সরে গেলো বাঁশ বাগানের মাথার ওপর দিয়ে। আমি নিরানব্বই পড়ে ফেলেছি, কয়েক হাজার, কয়েক লক্ষ, কয়েক কোটি’র শেষের নিরানব্বই।
সাপ্তাহিক ছুটি বা কোন কার্যদিবসে যদি চোখ খুলে দেখি সে এসেছে। মায়ার দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দৃষ্টি সীমার সমতলে, এই দিকে। হাত ধরে কি বলবে, ‘কেমন আছো তুমি? ভালো আছো তো?’
সেই আঠাশ বছর আগের এক ছুটির দিন। দিনটা ছিলো রবিবার। সাপ্তাহিক ছুটির খোলা দিবস। ছেলেবেলার সেই পুরনো ঝাপসা কথা। ডায়েরীর পাতায় ধূলোবালি মাখা সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের ছবি। পূর্ণিমা’র সেই চলে যাবার মুহূর্তে এক কিশোরের চমকে ওঠা। সে একটু থেমে আমাকে বললো... মাথা নীচু করে, ‘আমাকে কিছু বলবেন?’ ‘না, মানে বলবো না।’ সেই পালিয়ে আসার পরে পার হলো গোটা দু’যুগেরও বেশী। সেই পূর্ণিমা চলমান, আজও আমাকে ঘিরে আছে। দু’হাতে কিছু প্রশ্ন লেখা ছিলো, এখনও সেসব মনের আবরণ চিবিয়ে খায় বলে খামোখাই নিজের চুল ছিঁড়ি। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে খেলা করি। ভাষা খুঁড়ি। পরিণত যুবকটি যখন সংক্ষিপ্ত পূর্ণিমা’কে না বলেছিলো, পরিণতি জেনেই বলেছিলো। সেই আলোকজ্জ্বল পবিত্র প্রেমকে পূর্ণতা দিতে যে যোগ্যতা চাই তা তো ছিলো না যুবকের। তখনই ভুলতে চলা মন হারিয়ে ফেলেছে চাঁদের মুখ। আঁধার অমাবস্যায় জীবন সাজাতে দৃঢ় প্রতীজ্ঞ বলেই সেদিনের ‘না’।
সেই কিশোর থেকে পরিণত যৌবনে পদার্পণ করা পূর্ণিমা’র তখনই এক যুগ অপেক্ষার পালা ক্ষয়ে গেছে। সে নিশ্চয়ই গুণে ফেলেছে ততোক্ষণে কয়েক কোটি নিরানব্বই.. চোখ বন্ধ রেখে। আমার খোঁজে। হতাশ করে নিজেকে.. পালিয়ে ছিলাম। শুধু একটি দর্শণে নয়, একটি বিজ্ঞানের কোন পাতার যৌথ পড়ালেখায় কখনও ভালোবাসা হয়? জানতে পারিনি আজও। কিন্তু আজ যা জেনেছি তা হলো সেই অপারগতা আমাকে নরকে নিয়ে গেছে। আমি আজ মিথ্যা প্রতীক্ষার দিন গুণি বসে বসে। কাগজের কালিতে শূণ্যতা আঁকি। বেদনার কথা লিখি ব্লগে, কবিতা বা গল্পের মাঝে।
তুমি গল্পের কথা শুনে মনে করতে যেও না আমি নিরানব্বই ভাগ সত্যি বলছি। হা...হা...হা... আমি এক শতাংশও মিথ্যা বলছি না। এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি। সেই কিশোর বা যুবকের সাথে চাঁদমুখের প্রেমের কথা.. মোটেও মিথ্যা না সেসব। ওসব পানসে কথা, লেখার মতোই বৈশিষ্ট্যহীন সাদা পাতা। পাতা বাড়ানোর জন্য এমন প্রলাপ কেন হবে! কেন হবে পূর্ণিমার সাত সতেরো...! আমি বসে আছি পুকুর পাড়ে। সেই পুকুরটায়। যেখানে আঁধার ছিলো, নির্জনতা ছিলো, দূর আকাশের তারার পলায়ন ছিলো। চোখ বুঁজে সেই গূণতে থাকা.. এক.. দুই... করে কোটির ঘরে। তারপর.. নিরানব্বই... আবার অপেক্ষা, আবার মনে মনে কতো কথা.. ভাবতে থাকা। কই মৎস্য-কুমারী যে এলো না! বসন্ত পেরিয়ে গৃহস্থের বুকে শুষ্কতা এলে সেচে কি জল আসে? আসে শুধুই উষ্ণতা, উত্তাপ, প্রখরতা। দিন চাই না যে এমন বেরসিক... বুক পোড়ানো, চির-ধরানো! পোড়ামাটিতে শুকিয়ে যাওয়া পুকুরে মৎস্য-কুমারী যে বাঁচবে না। আমার অপেক্ষার শেষ চাই। চাই না সামনের চৈত্রে শুকনো ভবিষ্যৎ! কোন রাজার লোক, সৈন্য-শাষক, চোর-ডাকাত কেউ ছদ্মবেশে... কেউ যদি ভুলিয়ে নেয়! কেউ যদি তাকে উঠিয়ে নেয়! সাগর তীরে চৌবাচ্চা খুঁড়ে কেউ যদি তাকে সাজিয়ে নেয়! কি হবে আমার ভাগ্য গণনার? কি হবে এতো প্রতীক্ষার? এক, দুই, তিন করে নিরানব্বই তারপর লক্ষ-কোটি গুণতে থাকার? আমি তবে জল হবো।
এই দেখো প্রশান্ত বা আটলান্টিক মহাসাগরের নীলে নীল চারিদিক। এক মৎস্য-কুমারী’কে পাবার আশায় কষ্ট বেলা আঁধার পেরিয়ে দু’খন্ড তারার বিচ্যুতিতে সময় গড়ানো ভীত আমি... চৈত্রকে দূরে ঠেলে সাগর সেজেছি। কি বিশাল বুকে উত্তাপের প্রখরতা ধারণ করে চলেছি। মৎস্য-কুমারী খেলে যায় আমার বুকের ওপর দিয়ে। বেলা ভূমিতে চাঁদ এসে পূর্ণিমায় হাসছে আর আমার চিত্তে প্রচ্ছন্ন বিনোদনে ভালোবাসছে দিগন্তে ওড়া সব পাখীরাও। মালিকানা যে যার থাকুক না কেন, আজ জলের তলে বা উর্দ্ধ চোয়ালে যা দেখা যায় তার সবই আমার। স্বপ্ন চুরির খেলাতে অপেক্ষাকে চুরি করেছি বলেই চোখের জলে সাগর আমার। তাতেই সবার উচ্ছাস আর আবেগ। ব্লগের নামটি বলো না কি দেবো?
[রচনাকালঃ ২৯ মার্চ ২০১৩, সময়কালঃ রাত: ৯:০৯ মিনিট।]
No comments:
Post a Comment